সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে এক মাস ধরে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি পালন করছে বিএনপি। তবে এখনো আন্দোলনের চূড়ান্ত সাফল্যের পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। বরং নির্বাচনী ট্রেনে উঠে পড়েছে দেশ। আওয়ামী লীগ ছাড়াও জাতীয় পার্টিসহ অধিকাংশ নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল সংবিধান মেনে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। সাবেক সংসদ সদস্যসহ বিএনপির বেশকিছু নেতা অন্য দলে যোগ দিয়ে এরই মধ্যে ভোটে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আরও কিছু নেতার দল ছেড়ে নির্বাচনে যাওয়ার গুঞ্জনও রয়েছে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কারাগারে। অন্যরা গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে। ফলে খুব বেশি নেতাকর্মীকে সমবেত করে রাজধানীতে কর্মসূচি পালন করতে পারছে না বিএনপি। কোথাও কোথাও নিরাপদ সময়ে ঝটিকা মিছিল বা পিকেটিং থাকলেও তাতে কেন্দ্রীয় নেতাদের তেমন দেখা যায় না। আন্দোলন এগিয়ে নিতে কেন্দ্রের সঙ্গে তৃণমূলের যোগাযোগেও ঘাটতি পড়েছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে সহসাই পরিস্থিতির ‘ইতিবাচক’ পরিবর্তন হবে—সে আশা ক্রমেই ক্ষীণ হচ্ছে। এ কারণে বিএনপির তৃণমূলে এক রকম হতাশা ও বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। তবে দলটির হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে এমন পরিস্থিতিতেও নেতাকর্মীদের হতাশ না হয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আশ্বস্ত করা হয়েছে, ধারাবাহিক আন্দোলন এবং অবাধ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে পশ্চিমা বিশ্বের অব্যাহত চাপে শিগগির পরিস্থিতির ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটবে।বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, ‘একদফার জনসম্পৃক্ত চলমান আন্দোলন নস্যাৎ করতে সরকার নানা ষড়যন্ত্র করছে। অবিরাম গ্রেপ্তার অভিযান চলছে। একইভাবে চলছে বিএনপি নেতাকর্মীকে ধরার জন্য বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি অভিযান। নেতাকর্মীদের না পেলে পিতা, ভাই, আত্মীয়স্বজনকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে অত্যাচার-নির্যাতন, মামলা-হামলা, গ্রেপ্তারসহ শত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও নেতাকর্মীরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলমান থাকবে।’গত ১২ জুলাই থেকে একদফা দাবিতে আন্দোলনে নামে বিএনপি। অক্টোবরে দুর্গাপূজার আগ পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে মানববন্ধন, পদযাত্রা, বিক্ষোভ, সমাবেশের মতো কর্মসূচি পালন করে দলটি। এই সময়ে হাজার হাজার এমনকি লক্ষাধিক নেতাকর্মী নিয়েও কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। এরপর দুর্গাপূজার পর ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশের মধ্য দিয়ে সরকারবিরোধী চূড়ান্ত ধাপের আন্দোলনে নামার ঘোষণা দেয় বিএনপি। কিন্তু নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত ওই মহাসমাবেশ ঘিরে সহিংস পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ওই ঘটনার জেরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীসহ গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়। দলীয় সিদ্ধান্তে গ্রেপ্তার এড়াতে অন্য নেতারা আত্মগোপনে চলে যান। এরপর থেকেই তালাবদ্ধ বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দাবি আদায়ে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচির ডাক দেয় দলটি। গত ২৯ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত সাত দফায় ১৫ দিন অবরোধ এবং দুই দফায় তিন দিন হরতাল করেছে বিএনপি।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আবারও নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ঘোষিত তপশিলে মনোনয়নপত্র দাখিলের আগের দিন বুধবার ভোর ৬টা থেকে দেশব্যাপী ২৪ ঘণ্টার অবরোধ এবং মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন বৃহস্পতিবার সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা সর্বাত্মক হরতাল ডেকেছে বিএনপি। সপ্তম দফায় দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ শেষ হওয়ার আগে গতকাল সোমবার বিকেলে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। যুগপৎভাবে এ কর্মসূচি পালিত হবে।
গত এক মাসের কর্মসূচি বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকায় ‘ঝটিকা কৌশলে’ বিক্ষোভ মিছিলের মধ্য দিয়ে
হরতাল-অবরোধ সফল করার চেষ্টা করছে বিএনপি। দলটির কেন্দ্রীয় কমিটি ৫৮৪ সদস্যবিশিষ্ট হলেও হাতে গোনা ১৫-২০ জন নেতাকে কর্মসূচিতে দেখা গেছে। আর ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে
৪-৫টির গুটিকয় নেতা মাঠে সক্রিয় আছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের মধ্যে রুহুল কবির রিজভী, ডা. রফিকুল ইসলাম, সেলিমুজ্জামান সেলিম, মীর নেওয়াজ আলী নেওয়াজ, আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, আকরামুল হাসান, কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, ফজলুর রহমান খোকন, ইকবাল হোসেন শ্যামল, হাসান মামুনসহ আরও কয়েকজন হরতাল-অবরোধের সমর্থনে রাজপথে ঝটিকা মিছিল করেন। এ ছাড়া ঢাকা জেলা বিএনপির সভাপতি খন্দকার আবু আশফাক ও সাধারণ সম্পাদক নিপুন রায় চৌধুরীও কর্মসূচি সফলে মাঠে নামেন। অঙ্গসংগঠনের মধ্যে রাজপথে সবচেয়ে সক্রিয় দেখা গেছে ছাত্রদল, যুবদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলকে। তবে কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির অংশগ্রহণ একেবারেই সীমিত। দুই মহানগরে ৫০টি থানা কমিটি থাকলেও হাতেগোনা কয়েকটির নেতারা সক্রিয় রয়েছেন।
গ্রেপ্তার এড়াতে হরতাল-অবরোধের সমর্থনে বিএনপি নেতাকর্মীরা মূলত ঝটিকা মিছিল করছেন। পরিস্থিতি বুঝে তুলনামূলক নিরাপদ সময়ে বিশেষ করে ভোরের দিকে ১০-১৫ জন নেতাকর্মী জড়ো হয়ে মিছিল করেন। পিকেটিংয়ের ক্ষেত্রেও নেই তেমন কোনো তৎপরতা। কোথাও কোথাও ঝটিকা মিছিল বা পিকেটিং থাকলেও তাতে খুব বেশি নেতাকর্মী সমবেত হন না। কর্মসূচি বাস্তবায়নে নেতাকর্মীদের সমবেত হয়ে বড় পরিসরে রাজপথে না নামা এবং এই ‘ঝটিকা কৌশল’-এর মিছিল নিয়ে তৃণমূলে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। তাদের প্রত্যাশা ছিল, কেন্দ্রীয় নেতারা বেশি সংখ্যায় রাজপথে নামবেন এবং বেশি সময় ধরে কর্মসূচি পালন করবেন; কিন্তু কর্মসূচিতে তাদের প্রত্যাশিত উপস্থিতি না থাকায় তৃণমূলের নেতাকর্মীরা হতাশ।তারা বলছেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে সারা দেশে ব্যাপক আন্দোলন হলেও রাজধানী ঢাকায় শক্তভাবে কর্মসূচি না হওয়ায় তখন আন্দোলনে সফলতা আসেনি। এবারও ঢাকায় জোরালো আন্দোলন না হলে এবং নেতাকর্মীরা ব্যাপক হারে রাজপথে না নামলে কর্মসূচি সফল হওয়া কঠিন।চলমান হরতাল-অবরোধে ঢাকায় অধিকাংশ কর্মসূচিতে রাজপথে সক্রিয় রয়েছেন মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্য নাদিয়া পাঠান পাপন। তিনি সম্প্রতি নিজের ফেসবুকে এক পোস্টে প্রশ্ন রেখেছেন, ‘কমিটি করার সময় ত্যাগীদের বাদ দিয়ে যারা নিজেদের সমিতি বানিয়েছেন, আজ সেসব সমিতির সদস্যরা কোথায়? এর উত্তরে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির এই নেত্রী লেখেন, আগামী কমিটিতে বড় পদ বাগিয়ে নেওয়ার জন্য টাকা কামানোতে ব্যস্ত।’এদিকে বিএনপির হরতাল-অবরোধের কর্মসূচিকে ঘিরে ঢাকার মতো সারা দেশেরও বেশিরভাগ নেতাকর্মী পলাতক। পরিবার থেকে তারা বিচ্ছিন্ন। স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারছেন না। গ্রেপ্তার এড়াতে অনেকে ঝোপঝাঁড়, ধানক্ষেতে কিংবা খোলা আকাশের নিচে রাত্রিযাপন করছেন। এ অবস্থার মধ্যেও তারা মাঠে থেকে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে কেন্দ্রের সঙ্গে তাদের যোগাযোগেও এক ধরনের সমন্বয়হীনতা দেখা দিয়েছে। শীর্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ নেতারা গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী সমন্বয়ের চেষ্টা করছেন।
জানা গেছে, এই পরিস্থিতিতে আন্দোলন এগিয়ে নিতে তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হচ্ছে। এমনকি বহিষ্কৃত নেতাদেরও ফোন দেওয়া হচ্ছে। মাঠে থেকে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করলে ভবিষ্যতে দলে মূল্যায়নের আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। বেশ কয়েকটি জেলার নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমনটা জানা গেছে।বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকাসহ সারা দেশে দলের কর্মসূচি মনিটরিং করা হচ্ছে। যেখানে ঠিকভাবে কর্মসূচি পালিত হচ্ছে না, এমন অনেক জেলার নেতাদের ইতোমধ্যে দলের পক্ষ থেকে তিরস্কার করা হয়েছে। তবে দলে ভাঙন সৃষ্টি হতে পারে, এমন আশঙ্কার কারণে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।বিএনপির দায়িত্বশীল এক নেতা বলেন, চলমান আন্দোলন সফল করতে দল জিরো টলারেন্স নীতি অবলম্বন করেছে। যারা কর্মসূচিতে মাঠে থাকছেন না, আগামীতে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে তারা থাকতে কিংবা আসতে পারবেন না। আর যারা বর্তমান প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও মাঠে থেকে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন, তাদের ভবিষ্যতে দলে পুরস্কৃত করা হবে। হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে সারা দেশের নেতাকর্মীদের দলের এমন কঠোর অবস্থানের কথা জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। আগামী দিনের কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি আরও বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
মাসজুড়ে তালাবন্ধ বিএনপি কার্যালয়: ঢাকায় ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ ঘিরে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনার পরদিন থেকে দলটির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় তালাবদ্ধ। তখন থেকেই কার্যালয় পুলিশের নিয়ন্ত্রণে। দলটির কোনো নেতাকর্মী কার্যালয়ে যাননি। গতকাল এক মাসের মাথায়ও একই অবস্থা বিরাজ করছে।