প্রিয় শিক্ষক মোহাম্মদ হোসেন আলী স্যার—যাঁর শিক্ষা আজও প্রেরণার বাতিঘর
বগুড়া জেলা প্রতিনিধি:
শিক্ষকতা তাঁর কাছে ছিল পেশা নয়, এক সাধনা। চকের গন্ধে মিশে ছিল নৈতিকতার শপথ। বোর্ডের অক্ষরে জেগে উঠত মানবতার পাঠ। পল্লী উন্নয়ন একাডেমী ল্যাবরেটরী স্কুল, বগুড়ার প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ হোসেন আলী স্যার ছিলেন এমন এক শিক্ষাগুরু—যিনি শিক্ষার সঙ্গে জীবনবোধকে এক সুতায় গেঁথেছিলেন। ঘটনাটি আশির দশকে, তখন তিনি ছিলেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তিনি শুধু একজন শিক্ষক নন, ছিলেন নৈতিকতা, অনুপ্রেরণা ও মানবিকতার এক উজ্জ্বল প্রতীক। বাংলা সাহিত্যের মহান পণ্ডিত ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর ছাত্র হিসেবে তিনি জ্ঞান ও চরিত্রের ঐক্যকেই শিক্ষার মূলমন্ত্র করে তুলেছিলেন। শ্রেণিকক্ষে তাঁর পাঠ ছিল পাঠ্যবইয়ের সীমা ছাড়িয়ে বাস্তব জীবনের শিক্ষা। তিনি প্রায়ই বলতেন, “শিক্ষা মানে কেবল বই জানা নয়—নিজেকে জানা, সমাজের জন্য কিছু করা।”
প্রশাসক হিসেবে তিনি ছিলেন কঠোর, কিন্তু ন্যায়পরায়ণ। শৃঙ্খলা ও দায়িত্ববোধের ক্ষেত্রে ছিলেন আপসহীন। তিনি নিজে উপস্থিতির খোঁজ রাখতেন, অনুপস্থিত ছাত্রদের বাড়িতে গিয়ে অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলতেন। লক্ষ্য ছিল একটাই—একজন সৎ, দায়িত্বশীল ও কর্মঠ মানুষ গড়ে তোলা। শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্পষ্ট ও অটল। ছাত্রদের কাছে স্বীকৃতি নেওয়ার নিয়ম, পোশাক-আশাক ঠিক রাখা, হাতের নখ ও চুলের পরিচ্ছন্নতা—সবই বাধ্যতামূলক। মেয়েরা স্কুলে অতিরিক্ত অলংকার পরে আসতে পারতেন না। এই কঠোর নিয়মাবলী তাঁর শিক্ষার নৈতিক ও জীবনমুখী দিকের অংশ ছিল। তিনি শিক্ষার্থীদের হাতে-কলমে কাজের মাধ্যমে জীবনধর্মী শিক্ষা দিতেন। ধান রোপণ করা, স্কুল পরিচ্ছন্নতা করা, মাঠ পরিষ্কার করা, স্কাউটিং ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম—সবকিছুতেই ছাত্রদের সম্পৃক্ত করতেন। তাঁর বিশ্বাস ছিল, “শ্রমই মহত্ত্বের মূল চাবিকাঠি।” তাঁর শিক্ষাব্যবস্থায় কেবল পাঠ্যজ্ঞান নয়, বাস্তব জীবনের শিক্ষা ছিল মুখ্য। তিনি ছাত্রদের দলবদ্ধতা, নেতৃত্ব ও মানবিকতার চর্চায় উৎসাহিত করতেন। কোনো ছাত্র ব্যর্থ হলে তিনি শুধু ছাত্রকেই নয়, শিক্ষক ও পরিবারকেও দায়ী করতেন। তাঁর মতে, একটি সন্তানের গঠন হল সমাজের সম্মিলিত দায়িত্ব। তাঁর শাসন ছিল দৃঢ়, কিন্তু হৃদয়গ্রাহী। কখনো কঠোর ন্যায়বিচারক, আবার কখনো স্নেহময় অভিভাবক। ছাত্রদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধা ও ভক্তিতে ভরা। তাঁর পরামর্শ আজও অনেকের জীবনের দিশারী। তিনি প্রায়ই শিক্ষার্থীদের বলতেন, “হে প্রভু, আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও—সুন্দর পৃথিবীর জন্য আমরা।” এই বাক্যটি ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। তাঁর হাতে গড়া অসংখ্য ছাত্র আজ দেশ-বিদেশে সুনামের সঙ্গে কাজ করছে। শিক্ষকতার মাধ্যমে তিনি শুধু বিদ্যা দেননি, জীবনের নৈতিক ও মানবিক শিক্ষা দিয়েছেন। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, তবে তাঁর শিক্ষা ও জীবনবোধ আজও প্রেরণার উৎস। তাঁর ছাত্র হতে পারা আমাদের জীবনের সর্বোচ্চ গৌরব। মোহাম্মদ হোসেন আলী স্যার ছিলেন শিক্ষক সমাজের গর্ব, এক জীবন্ত ইতিহাস। যাঁরা তাঁর ছায়াতলে বড় হয়েছেন, তাঁরা জানেন—তিনি ছিলেন শুধু প্রধান শিক্ষক নয়, এক আলোকিত জীবনের আদর্শ।
তথ্য দাতা ও বার্তা লেখক: মোঃ মহিদুল ইসলাম, ব্যাচ–১৯৯৪, দপ্তর সম্পাদক, অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, পউএ ল্যাঃ স্কুল এন্ড কলেজ, বগুড়া




