পাবনা জেলা বিশেষ প্রতিনিধি
লাবলু বিশ্বাস
কিছুদিন আগেও যে দিকেই যাওয়া যেত, কানে বাজত কাঠকাটার খটখট শব্দ। সেই খটখট শব্দ আর নেই।
ঈশ্বরদীর সাঁড়া ইউনিয়নের পালিদেহা ও আরামবাড়িয়া গ্রামের চিত্র ছিল এটি। গ্রামের ঘরে ঘরে শোনা যেত, কাঠের চাকার তৈরির শব্দ। ক্রেতা-বিক্রেতার আনাগোনায় মুখরিত থাকত মিস্ত্রিপাড়া। এখন নেই সেই প্রাণচাঞ্চল্য। আরামবাড়িয়া ও পালিদেহায় এখন শুধুই নিস্তব্ধতা।
একটা সময় ছিল, যখন গরু-মহিষের গাড়িই ছিল গ্রামের মানুষের চলাচল ও পরিবহনের একমাত্র বাহন। এসব গাড়ির চাকার প্রয়োজনে সাঁড়া ইউনিয়নের গ্রামে গড়ে উঠেছিল চাকার কারখানা। আধুনিকতার ছোঁয়ায় উত্তরাঞ্চলের ঐতিহ্য চাকাশিল্প এখন প্রায় বিলুপ্ত। বাপ-দাদার পেশা চাকা তৈরির কাজ ছেড়ে বিভিন্ন পেশায় জড়িয়েছেন কারিগররা। এখানে তৈরি গরু, মহিষ ও ঘোড়ার গাড়িতে ব্যবহৃত কাঠের চাকার কদর ছিল ভৈরব, গাজীপুর, সিলেট ও রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
ঈশ্বরদী জংশন ও আজিমনগর স্টেশন থেকে প্রতিদিন ট্রেনে করে এসব চাকা দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যেত।
সরেজমিনে দেখা যায়, গৌরীপুর ও পালিদেহা এলাকার সব কারখানা বন্ধ। মিস্ত্রিপাড়া পদ্মা নদীর করালগ্রাসে বিলীন হয়েছে।
কারিগর ও ব্যবসায়ীরা জানান, ৩০-৪০ বছর আগেও এলাকায় চাকা তৈরির অর্ধ শতাধিক কারাখানা ছিল। এখন ৪০ থেকে ৫০ জন এই ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা ধরে রেখেছেন। বাবলা কাঠসহ চাকা তৈরির বিভিন্ন সামগ্রীর দাম বাড়ায় এবং আগের মতো চাকার চাহিদা না থাকায় বেশির ভাগ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। তরুণ যুবকরা আর কেউ বাবা-দাদার এ পেশায় আসতে চায় না।
আরামবাড়িয়ার চাকা তৈরির কারখানার মালিক হামে মালিথা (৬৫) অনেক কষ্টে পৈত্রিক পেশা ধরে রেখেছেন। তিনি বলেন, এক সময় ঈশ্বরদীর আরামবাড়িয়া ও পালিদেহা গ্রামে প্রায় ৭০০ কারখানা ছিল। প্রতিদিন ৬০০ জোড়া চাকা তৈরি হতো। এখন পুরো এলাকায় ২০-২৫টি কারখানা রয়েছে। প্রতিদিন একটি কারখানায় এক জোড়া চাকা তৈরি হয়। আগে সহস্রাধিক মানুষ চাকাশিল্পের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন সেখানে ৪০-৫০ জন কারিগর এ পেশা ধরে রেখেছেন। পরিবারের চার পুরুষ ধরে এ কাজে নিয়োজিত থাকলেও ছেলে এখন গার্মেন্টসে চাকরি করছেন।
এ বিষয়ে লক্ষ্মীকুণ্ডার গাড়িয়াল বদর উদ্দিন (৬৫) বলেন, ‘প্রায় ৪০ বছর ধরে মহিষের গাড়ি চালাচ্ছি। দিনকে দিন চাকার দাম বাড়ছে। এক জোড়া ঢাকায় দুই-তিন বছর চলে। এখন সময় বাঁচাতে গরু-মহিষের গাড়ির কদর নেই। পিকআপ, নসিমন, করিমন ব্যবহৃত হচ্ছে।’